এলিনোরা রুজভেল্ট (1884-1962) — একটি বিশিষ্ট ব্যক্তি, যিনি মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায় এবং সমাজে মহিলাদের ভূমিকা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রেখেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 32তম রাষ্ট্রপতি ফ্র্যাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্টের স্ত্রীরূপে, এলিনোরা শুধুমাত্র “প্রথম মহিলা” হয়ে বসে থাকেনি, বরং একজন প্রকৃত সমাজকর্মী হয়ে উঠলেন, যার উদ্যোগ গুলো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলছে।
এলিনোরা রুজভেল্ট ১১ অক্টোবর ১৮৮৪ সালে নিউ ইয়র্কে একটি বিখ্যাত এবং ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাইরের দিক থেকে স্বাচ্ছন্দ্য হলেও, এলিনোরার শৈশব সহজ ছিল না: ৮ বছর বয়সে তিনি তার মাকে হারান, এবং দুই বছর পরে তার পিতা। তিনি তাঁর কঠোর এবং দাবিদার দাদীর কাছে বড় হন।
কৈশোরে এলিনোরা ইউরোপে শিক্ষা লাভ করেন, যেখানে তিনি আলেনসুড স্কুলে মেরি সুভেস্টারের অধীনে পড়াশোনা করেন, যিনি তার প্রগতিশীল ধারণার জন্য এবং তার ছাত্রীদের স্বাধীন চিন্তা বিকাশে সহায়তার জন্য পরিচিত ছিলেন। এখানেই এলিনোরা আত্মবিশ্বাস অর্জন করে এবং সামাজিক ন্যায় এবং সমতার ধারণা নিয়ে ভাবনা শুরু করে।
১৯০৫ সালে এলিনোরা তার দূরের আত্মীয় ফ্র্যাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্টকে বিয়ে করেন। তাদের বিয়েটি কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি রাজনৈতিক চুক্তিও ছিল। ফ্র্যাঙ্কলিন দ্রুত রাজনৈতিক অবস্থানে উঠে যান, এবং এলিনোরা তার রাজনৈতিক উদ্যোগে increasingly গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন।
১৯২১ সালে ফ্র্যাঙ্কলিন পোলিও রোগে আক্রান্ত হন, এবং এলিনোরা উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তার পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন, কঠিন সময়ে তাকে সমর্থন করেন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সহায়তা করেন। এই সময়ে তিনি সামাজিক কাজকর্মে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এবং প্রথমবারের জন্য জনসাধারণের কার্যক্রমে দক্ষতা অর্জন করেন।
১৯৩৩ সালে ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হন, এবং এলিনোরা প্রথম মহিলা হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু তার ভূমিকা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ছিল না। তিনি কর্মী সংগঠনগুলো পরিদর্শন করতেন, দেশব্যাপী ভ্রমণ করতেন, সাধারণ আমেরিকানদের সাথে কথা বলতেন, তাদের সমস্যা এবং প্রয়োজন বোঝার চেষ্টা করতেন। তিনি রাষ্ট্রপতির জন্য “শ্রবণ এবং দৃষ্টি” হয়ে উঠতেন, যা তাকে স্থানীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়ে দিত।
এলিনোরা সামাজিক উদ্যোগে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি দরিদ্র এবং বেকারদের সাহায্য করার জন্য কর্মসূচী অনুরোধ করতেন, মহিলা এবং শিশুদের অধিকার রক্ষার পক্ষে থাকতেন। তিনি নিয়মিতভাবে “আমার দিন” নামে একটি সংবাদপত্রের কলামে তার চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতেন, যেখানে তিনি বর্তমান সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতেন।
১৯৪৫ সালে ফ্র্যাঙ্কলিনের মৃত্যু পর এলিনোরা তার জনসাধারণের কাজকে ত্যাগ করেননি। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তাকে জাতিসংঘের মার্কিন প্রতিনিধি হতে প্রস্তাব করেন। এই পদে তিনি মানবাধিকার কমিশনের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার খসড়া তৈরি এবং গ্রহণে মূল ভূমিকা পালন করেন।
এলিনোরা সত্যিই বিশ্বাস করতেন যে মানবের সমতা এবং অধিকার তার জাতি, ধর্ম কিংবা লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার জন্য প্রযোজ্য। জাতিসংঘে তার প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, শান্তি এবং মানবিকতার মূলনীতি প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
এলিনোরা তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ 계속 করেছেন। তিনি বই লিখতেন, বক্তৃতা দিতেন, জনসাধারণের ক্যাম্পেইনগুলিতে অংশগ্রহণ করতেন, এবং সবসময় তাঁর আদর্শের প্রতি অনুগত থাকতেন। জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি আফ্রো-আমেরিকানদের এবং মহিলাদের অধিকার সংগ্রাম ও যুবকদের সমর্থনে মনোনিবেশ করেন।
এলিনোরা রুজভেল্ট ৭ নভেম্বর ১৯৬২ সালে মারা যান। তাঁর প্রস্থান পৃথিবীর জন্য একটি ক্ষতি ছিল, তবে তাঁর চিন্তাভাবনা, আইডিয়া এবং অর্জনগুলি এখনও বেঁচে আছে। তিনি ২০ শতকের অন্যতম মহান মহিলাদের মধ্যে এক হিসাবে বিবেচিত হন এবং সমতা ও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করা কয়েক মিলিয়ন মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকেন।
এলিনোরা রুজভেল্ট একটি বিশাল ঐতিহ্য রেখে গেছেন, যা আধুনিক সামাজিক নীতির অনেক দিককে প্রভাবিত করেছে। তাঁর জীবন ও কার্যক্রম সাহস, স্থিরতা এবং মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। একজন সমাজকর্মী হিসেবে, তিনি মানুষের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, সমতা এবং ন্যায় পৌঁছাতে অতি বড় অবদান রেখেছেন।
তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি — “কেউ আপনাকে আপনার সম্মতির ব্যতীত অযোগ্য হতে পারে না” — তাঁর জীবনের দর্শনের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। এবং আজও এলিনোরা রুজভেল্ট একটি অনুপ্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্ব হিসেবে থেকে যান, যিনি ন্যায় এবং পরিবর্তনের জন্য সংগ্রামকারী সকলের জন্য উদাহরণ।